Sunday, May 11, 2025

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা: গভীর বিশ্লেষণ ও বৈশ্বিক উদাহরণ

 



১. কখন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যুক্তিসংগত?
(ক) জাতীয় নিরাপত্তা ও সংবিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে। উদাহরণ:জার্মানিতে নাজি পার্টি নিষিদ্ধ (১৯৫৬): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান সংবিধান (*Grundgesetz*) ধারা ২১(২) অনুযায়ী, যে কোনো দল যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়, তা নিষিদ্ধ হতে পারে। ১৯৫৬ সালে Socialist Reich Party (SRP), একটি নব্য-নাজি দল, নিষিদ্ধ হয়।  
  - স্পেনে কাতালান বিচ্ছিন্নতাবাদী দল (২০২০): স্প্যানিশ সুপ্রিম কোর্ট Catalan Democratic Party (PDeCAT) -এর কিছু নেতাকে নিষিদ্ধ করেছিল কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার জন্য অবৈধ গণভোটের কারণে। 

(খ) সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে সমর্থন করলে:
উদাহরণ:  - তুরস্কে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (PKK): ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র PKK-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে, কারণ এটি তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালায়।  
  - ভারতে Students Islamic Movement of India (SIMI): সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে ২০০১ সালে নিষিদ্ধ হয়।  

(গ) বিদেশী প্রভাব ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে
-উদাহরণ: - মিশরে "মুসলিম ব্রাদারহুড" (২০১৩): সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়, অভিযোগ ছিল তারা বিদেশী তহবিল নিয়ে কাজ করছে।  
  - রাশিয়ায় "নাভালনি"-এর দল (২০২১): আলেক্সেই নাভালনির সংগঠনকে "চরমপন্থী" আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করে রুশ সরকার, যুক্তি দেওয়া হয়েছিল এটি পশ্চিমা দেশগুলির দ্বারা প্রভাবিত। 

২. কখন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা ক্ষতিকর!

(ক) গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষতি 
উদাহরণ: - বাংলাদেশে *জামায়াতে ইসলামী* (২০১৩): যুদ্ধাপরাধের মামলায় দলটির নেতৃত্ব দণ্ডিত হওয়ার পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে। তবে বিরোধীরা দাবি করে এটি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অংশ ছিল।  
  - পাকিস্তানে "মোহাজির কওমি মুভমেন্ট (MQM)": মাঝে মাঝে দলটির বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ উঠলেও, নিষিদ্ধকরণকে অনেক বিশ্লেষক সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেন।  

খ) রাজনৈতিক বৈধতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি
উদাহরণ: আলজেরিয়ায় Islamic Salvation Front (FIS) (১৯৯২): নির্বাচনে জয়ের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলে গৃহযুদ্ধ (*Algerian Civil War) শুরু হয়, যাতে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়।  
  - থাইল্যান্ডে *থাকসিন শিনাওয়াত্রা-সমর্থিত দলগুলি: বারবার নিষিদ্ধ হওয়ায় দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে দশক ধরে।  
 

(গ) আইনের অপপ্রয়োগ ও স্বৈরাচারের দিকে ঝোঁক 

উদাহরণ: - ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরোধী দলগুলি*: ২০১৭ সালে *Voluntad Popular* দলকে নিষিদ্ধ করে সরকার, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা নিন্দিত হয়।  
  - তুরস্কে HDP (Kurdish Party): এরদোয়ান সরকার কুর্দি রাজনীতিকে দমন করতে এই দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা যায়?
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করা জরুরি:  

1. স্পষ্ট আইনি প্রক্রিয়া: নিষিদ্ধকরণের আগে অবশ্যই স্বাধীন বিচারিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।  
2. প্রমাণের ভিত্তি: দলটি সত্যিই সহিংসতা বা সংবিধান লঙ্ঘন করছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে।  
3. সম্প্রীতি ও সংলাপের প্রচেষ্টা: নিষিদ্ধকরণ শেষ উপায় হওয়া উচিত; রাজনৈতিক সমাধান প্রথমে খোঁজা উচিত।  
4. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড: ইউ, ইউএন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলির নির্দেশিকা অনুসরণ করা উচিত। 

উপসংহার:
ন্যায্য যখন: দলটি সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাস, গণতন্ত্র ধ্বংস বা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা হুমকির মুখে ফেলে (যেমন নাজি পার্টি বা সন্ত্রাসী গ্রুপ)।  
অন্যায্য যখন: ক্ষমতাসীন দল শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য আইনের অপব্যবহার করে (যেমন ভেনেজুয়েলা বা তুরস্কের উদাহরণ)। 

Monday, April 8, 2013

কাশফুল

কাশফুল একেবারেই প্রাকৃতিক। ইদানীং কয়েকটি এলাকা ছাড়া এর নেই কোনো চাষবাস, নেই কোনো যত্ন-আত্তি। নদীর ধার কিংবা বিস্তীর্ণ বালুচরে বড্ড অবহেলায় ফোটে এই শরতে। দূর থেকে কাশের বনে তাকালে মনে হয়, শরতের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেয়ে দলে দলে কাশফুল যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সাদা কাশফুলের মঞ্জরি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। বীজে সূক্ষ্ম সাদা রোম। ঘাসের জ্ঞাতি কাশ হয় তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা। ঘাসের মতোই এর মূল গুচ্ছ। পাতা রুক্ষ ও সোজা রেখার মতো। লম্বায় আধা থেকে এক মিটার আর চওড়া ছয় থেকে ১৫ মিলিমিটার। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব এলাকায়ই কাশফুল দেখা যায়। বিশেষ করে হিমালয়ের আওতায় থাকা দেশগুলোতে কাশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সে কারণেই নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ আর ভুটানে শরৎ কাশফুল ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। মৌসুমি বন্যার পর নদীর দুকূলে জমা পলিমাটিতে ব্যাপকভাবে জন্ম নেয় কাশ। নেপালে কাশের চাষ করা হয় ঘরের ছাদ ও সবজিবাগানের বেড়া দেওয়ার জন্য। রুক্ষ, শুকনো ও পাহাড়ি এলাকায়ও কাশ জন্মায়। লাল আর শক্ত মাটির কাশ হয় আকারে ছোট। পাহাড়ি আর বালুর কাশের আকার সবচেয়ে বড়। অবহেলার ফুল হলেও কাশের ওপর অনেকের জীবিকা জড়িয়ে আছে। নেপালের মতো দেশের অনেক জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে কাশের চাষ হচ্ছে। ঝিনাইদহের কাশচাষিরা পানের বরজের কাজে ব্যবহারের জন্যই কাশের চাষ করেন। এ ছাড়া ঘরের ছাউনিতেও কাশের ব্যবহার হয়; যদিও দেশে এখন কাঁচা ঘর নির্মাণ কমে গেছে অনেক। আর সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের শুভগাছা চরে কাশবনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গরু-মহিষের খামার। উদ্ভিদবিজ্ঞানের মতে, কাশ ও আখ খুবই ঘনিষ্ঠ। এ জন্য কাশের আরেক নাম বুনো আখ বা ওয়াইল্ড সুগারকেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে কাশফুলকে সঙ্গী করেই আসে দুর্গাপূজা। কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum। Poaceae পরিবারের সদস্য। হিন্দিতেও এর নাম কাশ, মণিপুরি ভাষায় ইই, তামিলে পেক্কারিম্পু, তেলেগুতে কাকি চেরুকু, মারাঠিতে কামিস, কানাড়ায় কাদু কাব্বু, মালয়ালামে নান্নানা আর গুজরাটি ভাষায় কানাসাড়ো। সত্যজিৎ রায়ের পথের 'পাঁচালী' ছবির কথা মনে আছে? কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অপু আর দুর্গা। কাশবনের এই দৃশ্যটা নেওয়ার জন্য বছরখানেক সময় লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের। তুমুল বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কাশবনের সৌন্দর্য। তার পরের বছর আবার সেই একই জায়গায় কাশফুল ফোটার অপেক্ষায় থেকেছিলেন তিনি। কবি নির্মলেন্দু গুণ তো নিজের গ্রামের নামই বদলে রেখেছেন 'কাশবন'। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে কবির জন্মস্থান গ্রামের নাম ছিল কাশতলা। কাশফুলকে ভালোবেসে কবি রেখেছেন কাশবন। কবির কবিতায়ও উঠে এসেছে তাঁর কাশবন গ্রামের কথা_ 'আমার একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ছিল তার নামটিও ছিল ভারি সুন্দর_কাশতলা হয়তো একসময় কাশফুলের খুব প্রাচুর্য ছিল ওই গ্রামে আমি কবিত্ব করে তার নাম পাল্টে রেখেছিলাম কাশবন ভালোবেসে প্রেমিক যেমন তার প্রেমিকার নাম পাল্টে রাখে সে-ই আমার প্রথম কবিতা...।' এই কাশবন থেকেই ১৯৯১ সালে কুমির মার্কায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিলেন কবি। কাশবনে কুমিরের আবাস না থাকলেও ভারতীয় গণ্ডারদের প্রিয় আবাসভূমি হিসেবে কাশবন বিখ্যাত। কিছু পাখি কাশবনে বাসা বানায়; যেমন_কালো মাথার মুনিয়া, পানটুনি ইত্যাদি। এরা বাসা বানায় কাশপাতা বা কাশগাছ দিয়ে। কাশবনে না থাকলেও কাশপাতা দিয়ে বাসা বানায় বাবুই। কাশবনের উপকারের সীমা কেবল পানের বরজ, ঘরের চালা বা সবজিবাগানের বেড়া হিসেবে নয়, কাশফুলের আয়ুর্বেদীয় গুণও আছে। মাটিধস রোধ করতে চাষ করা হয়। আখের অঙ্কুরোদ্গম ছাড়াও বিশেষ ধরনের কাগজের মণ্ডও তৈরি হয় কাশ থেকে। সব মিলিয়ে কাশফুল কেবল শরতের মুগ্ধতার প্রতীকই নয়, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কাশের জীবন।