Monday, April 8, 2013

কাশফুল

কাশফুল একেবারেই প্রাকৃতিক। ইদানীং কয়েকটি এলাকা ছাড়া এর নেই কোনো চাষবাস, নেই কোনো যত্ন-আত্তি। নদীর ধার কিংবা বিস্তীর্ণ বালুচরে বড্ড অবহেলায় ফোটে এই শরতে। দূর থেকে কাশের বনে তাকালে মনে হয়, শরতের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেয়ে দলে দলে কাশফুল যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সাদা কাশফুলের মঞ্জরি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। বীজে সূক্ষ্ম সাদা রোম। ঘাসের জ্ঞাতি কাশ হয় তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা। ঘাসের মতোই এর মূল গুচ্ছ। পাতা রুক্ষ ও সোজা রেখার মতো। লম্বায় আধা থেকে এক মিটার আর চওড়া ছয় থেকে ১৫ মিলিমিটার। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব এলাকায়ই কাশফুল দেখা যায়। বিশেষ করে হিমালয়ের আওতায় থাকা দেশগুলোতে কাশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সে কারণেই নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ আর ভুটানে শরৎ কাশফুল ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। মৌসুমি বন্যার পর নদীর দুকূলে জমা পলিমাটিতে ব্যাপকভাবে জন্ম নেয় কাশ। নেপালে কাশের চাষ করা হয় ঘরের ছাদ ও সবজিবাগানের বেড়া দেওয়ার জন্য। রুক্ষ, শুকনো ও পাহাড়ি এলাকায়ও কাশ জন্মায়। লাল আর শক্ত মাটির কাশ হয় আকারে ছোট। পাহাড়ি আর বালুর কাশের আকার সবচেয়ে বড়। অবহেলার ফুল হলেও কাশের ওপর অনেকের জীবিকা জড়িয়ে আছে। নেপালের মতো দেশের অনেক জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে কাশের চাষ হচ্ছে। ঝিনাইদহের কাশচাষিরা পানের বরজের কাজে ব্যবহারের জন্যই কাশের চাষ করেন। এ ছাড়া ঘরের ছাউনিতেও কাশের ব্যবহার হয়; যদিও দেশে এখন কাঁচা ঘর নির্মাণ কমে গেছে অনেক। আর সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের শুভগাছা চরে কাশবনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গরু-মহিষের খামার। উদ্ভিদবিজ্ঞানের মতে, কাশ ও আখ খুবই ঘনিষ্ঠ। এ জন্য কাশের আরেক নাম বুনো আখ বা ওয়াইল্ড সুগারকেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে কাশফুলকে সঙ্গী করেই আসে দুর্গাপূজা। কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum। Poaceae পরিবারের সদস্য। হিন্দিতেও এর নাম কাশ, মণিপুরি ভাষায় ইই, তামিলে পেক্কারিম্পু, তেলেগুতে কাকি চেরুকু, মারাঠিতে কামিস, কানাড়ায় কাদু কাব্বু, মালয়ালামে নান্নানা আর গুজরাটি ভাষায় কানাসাড়ো। সত্যজিৎ রায়ের পথের 'পাঁচালী' ছবির কথা মনে আছে? কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অপু আর দুর্গা। কাশবনের এই দৃশ্যটা নেওয়ার জন্য বছরখানেক সময় লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের। তুমুল বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কাশবনের সৌন্দর্য। তার পরের বছর আবার সেই একই জায়গায় কাশফুল ফোটার অপেক্ষায় থেকেছিলেন তিনি। কবি নির্মলেন্দু গুণ তো নিজের গ্রামের নামই বদলে রেখেছেন 'কাশবন'। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে কবির জন্মস্থান গ্রামের নাম ছিল কাশতলা। কাশফুলকে ভালোবেসে কবি রেখেছেন কাশবন। কবির কবিতায়ও উঠে এসেছে তাঁর কাশবন গ্রামের কথা_ 'আমার একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ছিল তার নামটিও ছিল ভারি সুন্দর_কাশতলা হয়তো একসময় কাশফুলের খুব প্রাচুর্য ছিল ওই গ্রামে আমি কবিত্ব করে তার নাম পাল্টে রেখেছিলাম কাশবন ভালোবেসে প্রেমিক যেমন তার প্রেমিকার নাম পাল্টে রাখে সে-ই আমার প্রথম কবিতা...।' এই কাশবন থেকেই ১৯৯১ সালে কুমির মার্কায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিলেন কবি। কাশবনে কুমিরের আবাস না থাকলেও ভারতীয় গণ্ডারদের প্রিয় আবাসভূমি হিসেবে কাশবন বিখ্যাত। কিছু পাখি কাশবনে বাসা বানায়; যেমন_কালো মাথার মুনিয়া, পানটুনি ইত্যাদি। এরা বাসা বানায় কাশপাতা বা কাশগাছ দিয়ে। কাশবনে না থাকলেও কাশপাতা দিয়ে বাসা বানায় বাবুই। কাশবনের উপকারের সীমা কেবল পানের বরজ, ঘরের চালা বা সবজিবাগানের বেড়া হিসেবে নয়, কাশফুলের আয়ুর্বেদীয় গুণও আছে। মাটিধস রোধ করতে চাষ করা হয়। আখের অঙ্কুরোদ্গম ছাড়াও বিশেষ ধরনের কাগজের মণ্ডও তৈরি হয় কাশ থেকে। সব মিলিয়ে কাশফুল কেবল শরতের মুগ্ধতার প্রতীকই নয়, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কাশের জীবন।